ঐতিহাসিক ইতিহাসের পরিবর্তন
ঐতিহাসিক ইতিহাসের পরিবর্তন বলতে বোঝায় ইতিহাস লেখার পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণ কৌশলের পরিবর্তন যা বিভিন্ন সময় এবং প্রেক্ষাপটে ঘটে। এই পরিবর্তনগুলি মূলত ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবহারিক পদ্ধতি, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কারণে হয়ে থাকে। নিচে ঐতিহাসিক ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং তাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস: প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় ইতিহাস লেখার সময় মূলত ধর্মীয় ও পৌরাণিক উপাদানগুলির ওপর জোর দেওয়া হতো। ইতিহাস অনেক সময় কিংবদন্তি এবং ধর্মীয় গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে লেখা হতো।
পুনর্জাগরণ এবং রেনেসাঁ: রেনেসাঁ যুগে ইতিহাস লেখার পদ্ধতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসে। ইতিহাসবিদরা অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ এবং উৎসের উপর নির্ভর করতে শুরু করেন। ধ্রুপদী গ্রন্থাবলির পুনঃআবিষ্কার এবং মানবতাবাদের উত্থান ইতিহাস লেখাকে আরও বৈজ্ঞানিক করে তোলে।
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ: ঔপনিবেশিক যুগে ইতিহাস লেখার পদ্ধতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান ঘটে। ইউরোপীয় জাতিগুলি নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস লিখতে শুরু করে, যা অনেক সময় উপনিবেশভুক্ত জাতিগুলির ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করত।
উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক ইতিহাস: এই সময়ে ইতিহাসকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে দেখার চেষ্টা করা হয়। প্রমাণ, তথ্য এবং পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস লিখতে শুরু হয়। লিওপোল্ড ভন রাঙ্কে এই পদ্ধতির অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন, যিনি ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা এবং প্রাথমিক উৎসের উপর জোর দেন।
মার্ক্সবাদী ইতিহাস: কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী, ইতিহাস অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শ্রেণি সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করা হয়। এই পদ্ধতি ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা এবং বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে সমাজের নীচু স্তরের মানুষের কষ্ট এবং সংগ্রামকে গুরুত্ব দেয়।
আন্নাল স্কুল: ফ্রান্সে উদ্ভূত এই পদ্ধতি ইতিহাসের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রবণতাগুলির ওপর গুরুত্ব দেয়। এই স্কুলের ইতিহাসবিদরা ব্যক্তিগত ঘটনা এবং রাজনৈতিক নেতাদের উপর কম গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনগুলি বিশ্লেষণ করেন।
নারীবাদী ইতিহাস: নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস লেখার মাধ্যমে নারীর অবদান এবং অভিজ্ঞতাকে ইতিহাসের মূলধারায় নিয়ে আসা হয়। এই পদ্ধতি পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাস থেকে সরে এসে নারীর অধিকার, ভূমিকা এবং সংগ্রামকে গুরুত্ব দেয়।
পোস্টমডার্নিজম: পোস্টমডার্ন দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা এবং একক সত্য ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি মনে করে যে, ইতিহাস একটি সামাজিক নির্মাণ এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং বর্ণনামূলক কাঠামোর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়।
ডিজিটাল ইতিহাস: আধুনিক যুগে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ইতিহাস লেখার এবং গবেষণার পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল আর্কাইভ, ডাটাবেস এবং বিশ্লেষণাত্মক সরঞ্জামগুলি ইতিহাসবিদদের নতুন উপায়ে গবেষণা এবং উপস্থাপনার সুযোগ প্রদান করেছে।
এই পরিবর্তনগুলি ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য এনেছে, যা আমাদের অতীতকে আরও সমৃদ্ধ এবং বহুস্তরীয় ভাবে বোঝার সুযোগ দেয়।
-ধন্যবাদ