রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
ভুমিকাঃ
- পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণের অগ্রদূত। যেমন পেত্রাক ও বোকাশিও ছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁর অগ্রদূত। রামমোহন রায়কে “ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ” বলে অবিহিত করা হয়। কবির ভাষায় ‘ভারত পথিক’। স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর সামাজিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য তিনি সমগ্র জীবন কঠোর পরিশ্রম করে যান। আজ আমাদের সাহিত্য, ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি – যাকেই আমরা আধুনিক বলিনা কেন, রামমোহন হলেন তারই অগ্রদূত।
ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদানঃ
- প্রচলিত আঁচার-অনুষ্ঠান পৌত্তলিকতা হিন্দুধর্ম, নানা কুসংস্কার, লোকাচার এবং পুরোহিততন্ত্রের পাশবিক অত্যাচারে রামমোহন মর্মাহত হন। তিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সর্বস্ব হিন্দু ধর্মের বিরধিতা করেন। তিনি প্রচার করেন হিন্দু শাস্ত্রমতে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং একেশ্বরবাদই হল সকল ধর্মের মুল কথা। ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বহু দেববাদের বিরুদ্ধে এবং একেশ্বরবাদের সমর্থনে ‘একেশ্বরবাদীদের প্রতি’ ফরাসি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। কেবলমাত্র এই নয় – বেদ ও উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করে রামমোহন তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। রামমোহন তাঁর ধর্মমত আলোচনার জন্য ১৮১৪-১৮১৫ সালে ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য ১৮২৮ সালে (মতান্তরে ১৮২৯ খ্রিঃ) ‘ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৩০ খ্রিঃ) নাম ধারন করে। এইভাবে তিনি ঔপনিষদিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করেন নি – খ্রিষ্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকেও হিন্দু ধর্মকে রক্ষাও করেছেন। এপ্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, ব্রাহ্মসমাজ ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান – একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী সকল ধর্মের মানুষের জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত ছিল।
সমাজসংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ঃ
- পাশ্চাত্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রামমোহন এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, ভারতকে কুসংস্কার ও জড়ত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হলে হিন্দু সমাজব্যবস্থার সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন। একথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিকভাবে সমাজসংস্কারের ব্যাপারে রামমোহন ছিলেন অগ্রদূত। তিনি ছিলেন উদারপন্থী গভর্নর জেনারেল বেন্তিংঙ্কের সমসাময়িক এবং সমাজসংস্কারের ব্যাপারে তাঁর উগ্রসমর্থক। ধর্মসংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে রামমোহন সমাজসংস্কারেরও ব্রতী হন। প্রকৃতপক্ষে ধর্মসংস্কারের মূলে রামমোহনের উদ্দেশ্য ছিল সমাজসংস্কার। রামমোহন বিশ্বাস করতেন সমাজে নানা কুসংস্কারের প্রসার, হিন্দুদের নৈতিক অবনতি, পুরহিত শ্রেণির আধিপত্য প্রভৃতির মূলে হিন্দুদের চিরাচরিত ধর্মানুষ্ঠান। তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হল ‘সতীদাহ’ প্রথার বিরুদ্ধে। স্মিথের মতে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় সতীদাহ-প্রথা প্রচলিত ছিল এবং ভারতে বহিরাগত জাতিগুলি এর প্রচলন করেছিলেন। উৎপত্তি যেখানেই হউক না কেন, এই অতি প্রাচীন ও নিষ্ঠুর প্রথার ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার হিন্দু বিধবাকে স্বামীর চিতায় ঝাপ দিয়ে সহমৃতা হতে হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধবাদের আত্মীয়-স্বজন জোর করেই সহমৃতা হতে বাধ্য করতেন। ভারতে অভিজাত মুসলমান পরিবারেও এই প্রথা কালক্রমে ছড়িয়ে পরে। রামমোহনই সর্বপ্রথম সতী-প্রথার বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই ব্যাপারে লর্ড বেন্টিং ও দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেন। ১৮১৮ সালে তিনি এই কু-প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহের কাজে ব্রতী হন। এদিকে হিন্দুশাস্ত্র থেকে নানা উদ্ধৃতি তুলে দাবী করেন যে হিন্দুধর্মে সতী-প্রথার কোন স্থান নাই। অন্যদিকে তিনি সভা-সমিতির মাধ্যমে এই প্রথার বিরুদ্ধে মানুষের বিবেক ও শুভচেতনা জাগিয়ে তোলার নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত রামমোহনের অক্লান্ত চেষ্টায় ও ইংরেজ সরকারের সমর্থনে লর্ড বেন্টিং ১৮২৯ সালের ১৭নং রেগুলেশন (Regulation – XVII) দ্বারা সতীদাহ প্রথা চিরতরে নিষিদ্ধ করেন। সতীদাহ-প্রথা প্রসঙ্গে রামমোহন ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮ খ্রিঃ) একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন। তিনি জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথারও ছিলেন প্রবল বিরোধী। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রমান তুলে ধরার জন্য ‘ব্রজসূচি’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন। রামমোহন অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনেও কলম ধরেন। তবে, সমালোচকদের মতে, জাতিভেদ প্রথার বিরোধী হয়েও রামমোহন উপবীত ধারন করতেন। এপ্রসঙ্গে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেন “হিন্দু সমাজে পতিত হওয়ারভয়ে রামমোহন উপবীত ত্যাগের সাহস দেখাননি”। হিন্দু নারীকে সুশিক্ষা প্রদান করা এবং তাদের উত্তরাধিকারের দাবী স্বীকার করা প্রভৃতি ব্যাপারেও তাঁর চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। একথা অস্বীকার করা যায়না যে, রামমোহনের সমর্থন ও সহযোগিতার ফলেই বেন্টিং সামাজিক সংস্কার গুলি প্রবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ঃ
- আধুনিক শিক্ষাপ্রসারের উদ্দেশ্যে যারা প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন রামমোহন রায় তাদেরই একজন ছিলেন। দেশের মধ্যে আধুনিক ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়ার সবথেকে বড়ো উপায় ছিল আধুনিক শিক্ষা। লর্ড আর্মহাস্ট কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপনে উদ্যোগী হলে রামমোহন এর তিব্র প্রতিবাদ করেন। ১৮০০ সালে ডেভিড হেয়ার এদেশে একজন ঘড়ি প্রস্তুতকারক হিসেবে এসেছিলেন। তাঁর সম্পূর্ণ জীবনটাই তিনি এদেশে শিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করে দেন। ১৮১৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত হিন্দু কলেজ। রামমোহন হেয়ারকে শিক্ষামূলক এই কাজে সহায়তা করেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজ ব্যয়ে কলকাতায় একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় চালাতেন ১৮১৭ সাল থেকে। সেই বিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলবিদ্যায় (মেকানিক্স) ভলতেয়ার দর্শন পড়ানো হত। ১৮২৫ সালে তিনি একটি বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কলেজে ভারতীয় শিক্ষায় ও পাশ্চাত্য সামাজিক ও ভৌতবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম চালু ছিল।
অন্যান্য সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদানঃ
- তাঁকে নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন ও ভারতীয় সাংবাদিকতার আগ্রদুত এবং বাংলা গদ্যের জনক বলা যায়। তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং এই আদর্শই পরবর্তী কালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কতৃক অনুসৃত হয়েছিল। তিনি বাংলা, হিন্দি, ফারসি ও ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে উদ্যোগী হলে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি কৃষকদের দুর্দশা মোচনে যত্নবান হন এবং জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার, দেশীয় পন্যের উপর অধিক শুল্ক আরোপ, মুজুরি আইন, বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি এবং ইংরেজ রাজকর্মচারীদের আচরণের বিরুধে প্রতিবাদ জানান। এছাড়া তিনি সরকারি উচ্চপদগুলি ও সমর বিভাগের ভারতীয়করণ, জুরিপ্রথার প্রবর্তন এবং বিচারের ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ইউরোপীয় নির্বিশেষে একই আইন প্রয়োগের দাবী জানান।
উপসংহারঃ
- সকল দিক দিয়ে বিচার করলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতকে আধুনিক ভাবে গড়ে তোলার যে সকল আন্দোলন পরবর্তী কালে ব্যাপকতা লাভ করেছিল তার ভিত্তিপ্রস্তর রাজা রামমোহন রায় রচনা করে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবনচরিত-প্রণেতার ভাষায় “The Raja presents a most instructive and inspiring study for the new India of which he is the type and pioneer. He embodies the new spirit.”
পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মসংস্কার সামাজিক সংস্কার, শিক্ষাসংস্কার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, কৃষকদের অবস্থার উন্নয়ন, ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার প্রভতি বিভিন্ন বিষয়ে রাজা রামমোহন রায়ের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই ডঃ বিপান চন্দ্র যথার্থই বলেছেন “উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় আকাশে রামমোহন রায় উজ্জ্বলতম নক্ষত্ররূপে ভাস্কর ছিলেন।”
-ধন্যবাদ