ধ্বনি পরিবর্তনের স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য ও কারণসমূহ
ধ্বনির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য:
ভাষার গতি নদীর মতোই পরিবর্তনশীল। ভাষায় এই পর। পরিবর্তন মূলত ধ্বনি পরিবর্তন। প্রত্যেক ভাষাতে ধ্বনিগুলির পরিবর্তন সর্বত্র একই রূপে উচ্চারিত হয় না। স্থান থেকে স্থানান্তরে এ ধ্বনিগত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ৰূপে লক্ষ্য করা যায়। পরে ভরি ধ্বনি পরিবর্তন বিশেষ নিয়মের মধ্যে সাধিত হয়। যেমন সংস্কৃত 'জত্ব', 'মধু', বধু', 'সখি' বাংলায় হয়েছে জৌ, মৌ, বৌ, সই। এই উদাহরণ থেকে এই সূত্র পাওয়া যায় যে পদান্ত্যে 'উ'কার পরবর্তীকালে অক্ষুন্ন থেকেছে, কিন্তু পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনধ্বনিকে লুপ্ত করে দিয়েছে। যেমন- 'জত্ব'-জ+ত+উ, মধু-ম+ধ+ উ। প্রাচীন বাংলায় রাতি 'পাতি', 'ফাণ্ড' আধুনিক বাংলায় হয়েছে- রাত, পাত, ফাগ। এ থেকে এই স্বরূপ বা সূত্র পাওয়া যায় যে, প্রাচীন বাংলায় অন্ত্য 'ই' কার ও 'উ' কার আধুনিক বাংলায় লুপ্ত হয়েছে।
ধ্বনি পরিবর্তনের এই স্বরূপ বা সূত্রগুলি সর্বক্ষেত্রেই একইরূপে প্রযুক্ত নয়। অনেক সময় এগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা যায়। ধ্বনি পরিবর্তনের এই সূত্রটি কোন বিশেষ ভাষার বিশেষ অবস্থাতেই সংঘটিত হয়, তাছাড়া শব্দের মধ্যে ধ্বনিগুলির সুনির্দিষ্ট সংস্থানের সূত্রানুযায়ী পরিবর্তন ঘটে; অন্যত্র এই সূত্র নাও ঘটতে পারে। একথা স্মরণীয় যে, ধ্বনি পরিবর্তন দেশের সর্বত্র একইরকম ভাবে উচ্চারিত হয় না। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের উপভাষায় ধ্বনি পরিবর্তনের উচ্চারণ পদ্ধতি আলোচনা করলেই এ সম্বন্ধে ধারণা সুস্পষ্ট হবে। সাধু বাংলায় 'রাতি' 'আজি' 'কালি' পূর্ববঙ্গে উচ্চারিত হয়- 'রাইত' 'আইজ' 'কাইল'; পশ্চিমবঙ্গে উচ্চারিত হয়- 'রাত' 'আজ' 'কাল'।
ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মের মধ্যেও ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন (সং) কর্ম (প্রাঃ) কবুত কাম। এখানে সংস্কৃত যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি প্রাকৃতে যুগ্ম ব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছে, আর বাংলার ক্ষেত্রে সেই যুগ্ম ব্যাঞ্জন একক ব্যাঞ্জনে পরিণত হয়েছে একা এই ব্যঞ্জনে পূর্ববর্তী 'হ্রস্ব' ধ্বনি দীর্ঘ হয়েছে। ধ্বনি পরিবর্তনের এই বেশিক্ষগুলি বাংলা ভাষায় প্রায় সর্বত্রই প্রযোজ্য। কিন্তু সংস্কৃত সর্ব প্রাকৃতে হয়েছে 'মন্দ', তা থেকে বাংলায় হওয়া উচিত ছিল- 'সাব'; কিন্তু তা না হয়ে হল- সব। মনে করা হয় যে 'সভা' শব্দের সাদৃশ্য বা অন্যান্য সূত্র ধ্বনি পরিবর্তনে এরূপ ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতে পারে।
ধ্বনি পরিবর্তনের কারণঃ
ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ অনেক। বস্তার জিহ্বার জড়তা, শ্রোতার শ্রবণ শক্তির ত্রুটি, পরিচিত অন্য ভাষার ফানির প্রভাব, ব্যকি বিশেষের উচ্চারণের অনুকরণ প্রভৃতি নানা কারণে ফানি পরিবর্তিত হয়। এই সমস্ত কারণ বহিরঙ্গ, আসলে ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণের বৈষম্যই শেষ পর্যন্ত ধ্বনি পরিবর্তন ঘটায়। বিশেষ উচ্চারণ পদ্ধতি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সংক্রামিত হতে পারে। ফলে একজনের শব্দ বিকৃতি অন্য জনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এইভাবে ব্যক্তি থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে গোছিতে, গোষ্ঠী থেকে সমাজে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্রবের ফলেও ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে মুসলমান শাসনকালে বহু ফারসি শব্দ প্রচলিত শব্দকে স্নান করে দিয়েছে। ইংরেজ আমলে এই ধ্বনি পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বহু ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় ধ্বনির দিক থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন- ইষ্টিশান, ইস্কুল, বেঞ্চি। তাছাড়া বিদেশি শব্দকে দেশের লোকেরা নিজেদের মতো করে উচ্চারণ করলে তাতেও ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। ইংরেজি শব্দ হসপিটাল' (Hospital) বাংলায় হয়েছে-হাসপাতাল এবং 'আর্মি চেয়ার' (Armi chair) হয়েছে 'আরাম চেয়ার' বা 'আরাম কেদারা'। এই ভাবে পর্তুগীজ শব্ - 'আনানস' পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় হল- 'আনারস'। ভৌগোলিক অবস্থান ধ্বনি পরিবর্তনের একটি গৌণ কারণ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা ভৌগোলিক অবস্থানের উপর দেশের আবহাওয়া। নির্ভর করে, আবার এই আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে অধিবাসীদের দেহচর্চা এবং শরীরপ্রক্রিয়া। তাই একই ধ্বনির উচ্চারণে স্থান বিশেষে অংশত পরিবর্তন দেখা যায়। পূর্ববঙ্গের 'কাক' 'শার্ক' শব্দ-গুলি ধ্বনি পরিবর্তনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের লোকভাসায় উচ্চারিত হয় 'কাগ' ও 'শাগ'।
কখনো কখনো বর্ণ বিপর্যয়ের ফলে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে। যেমন- বাক্স বাস্ত। বিষমীভবন ও এরূপ বিভিন্ন কারণেও ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। যেমন-রিক্সা রিস্কা, পিচাশ পিশাচ, লাল নাল (গ্রাম্য উচ্চারণে) জন্ম জন্ম, কর্ম কম্ম প্রভৃতি। ভাষার অভ্যন্তরে যে সুষমতা দেখা যায় তা আসলে ভাষার স্বভাব বিরুদ্ধ অর্থাৎ কৃত্রিম। আমরা মুখে যা বলি তাইই আসল ভাষা। প্রতিটি সামাজিক গোষ্ঠী ও পরিবারবিশেষের মধ্যে প্রচলিত ভাষায় বা উপভাষায় এরূপ কিছু বিশিষ্টতা থাকে, যা অন্য দল বা গোষ্ঠীতে পরিলক্ষিত হয় না। এই বিশিষ্টতাগুলি এক ভার একটি উপভাষার বীজ। এর গভীরে অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টি আরোপ করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেক দলের উপভাষার মূলে আছে সেই দলের প্রতিভাবান ব্যক্তির বা পরিবারের বিশেষ বাচনভঙ্গি।
তাই ভাষার বিশেষত্বের প্রকৃত অনুসন্ধান করলে ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষের বাক ব্যবহারের সূত্র পাওয়া যাবে। ভাষাতত্ত্ববিদগণ এই প্রত্যয় প্রকাশ করেন যে, ধ্বনি পরিবর্তনের মূল অন্বেষণ নিত করলেও পরিশেষে আমরা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষের উচ্চারণ করে ভঙ্গিতে পৌঁছতে পারি। কিন্তু এই অভিমত প্রমাণ করা সহজ সাধ্য নয়। তাই ধ্বনি পরিবর্তনের কোন একটি বিশেষ সূত্রকে এই পরিবর্তনের একমাত্র কারণরূপে র। অভিহিত করা যায় না। কেননা, ধ্বনি প্রাকৃতিক নিয়মে বহতা নদীর ন্যায় সদা পরিবর্তনশীল।
-ধন্যবাদ