সিনেমা জগতে সত্যজিৎ রায় এর নাম খুব চর্চিত কারণ তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ভারতীর চলচ্চিত্র নির্মাতা এছাড়া তিনি চিত্রকার ও তার গল্প লেখার মাধ্যমে দেশের সত্য ও মর্মস্পর্শী চিত্র উপস্থাপন করেছিলেন।
সত্যজিৎ রায় তার জীবনে মোট 29 টি চলচ্চিত্র এবং 10 টি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” একটি আদর্শ চলচ্চিত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। ৩২ টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায় বিশ্বে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
(নিম্নে সেই মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের জীবনী ও চলচ্চিত্র নির্মাণে তার অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।)
সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক। পথের পাঁচালী, অপরাজিত (1956) ও অপুর সংসার (1959) – এই তিনটি একত্রে অপু ত্রয়ী নামে পরিচিত, এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী সত্যজিতের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বহুল স্বীকৃত।
1921 খ্রি : 2 রা মে ময়মনসিংহের মসুয়ার জমিদার বংশে সাহিত্যিক , চিত্রশিল্পী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ।
তার পিতা বাংলা শিশু সাহিত্যে খেয়ালরসের স্রষ্টা সুকুমার রায় , মাতা সুপ্রভাদেবী ।
এই বংশেরই উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী ছিলেন শিশু সাহিত্যিক , সংগীত , চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রকুশলী । সত্যজিৎ ছিলেন তারই পৌত্র ।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতই মসুয়ার রায়চৌধুরী পরিবারও বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ অবদানের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ।
তার যখন আড়াই বছর বয়স তখন তিনি পিতৃহারা হন , মাতা সুপ্রভাদেবীর সঙ্গে সত্যজিৎ ছয় বছর বয়স থেকে মামার বাড়িতে থাকেন । মায়ের কাছেই প্রাথমিক পড়াশুনা আরও । সংসারের প্রয়ােজনে সুপ্রভাদেবীকে একসময়ে বিদ্যাসাগর বানীভবন বিদ্যাশ্রমে সেলাইয়ের কাজও করতে হয়েছিল ।
দশ বছর বয়সে বালিগঞ্জ হাইস্কুলে ফিথ ক্লাসে অর্থাৎ এখনকার মতে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন । এখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি . এ পাশ করেন 1968 খ্রিঃ ।
বাবা এবং ঠাকুরদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেই শিল্প সাহিত্যের প্রতিভা লাভ করেছিলেন সত্যজিৎ । স্কুলে থাকতে বাড়ির সংগ্রহের রেকর্ড শুনে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে দীক্ষিত হয়ে যান । ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হিসেবে এর পাশাপাশি ব্রহ্মসঙ্গীত , রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রতিও অনুরাগ জন্মেছিল ।
চিত্রশিল্পের চর্চা বাল্যবয়স থেকেই ছিল । বি . এ পাশ করার পর শিল্প শিক্ষার জন্য ভর্তি হন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে । কিন্তু আধুনিকমনা সত্যজিতের পক্ষে এখানকার পরিবেশ মনঃপুত না হওয়ায় শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই কলকাতায় চলে আসেন ।
1940 খ্রিঃ এপ্রিল মাসে তিনি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কোম্পানি ডিজে কিমার সংস্থায় জুনিয়র ভিসুয়ালাইজার হিসেবে যােগ দেন । এই সময়েই তিনি সিগনেট প্রেস প্রকাশন সংস্থার বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন । ছােটদের পত্রিকা মৌচাকেও তার প্রথম আঁকা অলঙ্করন প্রকাশিত হয় ।
অক্ষরলিপিতেও এই সময় তিনি দক্ষতা অর্জন করেন । পরবর্তীকালে অক্ষরলিপিতে রােমান টাইপ সিরিজ তার বিশেষ অবদান বলে স্বীকৃত হয় । কয়েক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের আর্ট ডিরেক্টারের পদে উন্নীত হন । তার প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীর সাফল্যের পর 1956 খ্রিঃ এই চাকরিতে ইস্তফা দেন।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিতপথের পাঁচালীর প্রথম প্রদর্শনী হয়নিউইয়র্কে 1955 খ্রিঃ এপ্রিলে। কলকাতায় মুক্তি পায় সেই বছরেই 26 শে আগস্ট । ছবিটি সেই বছরইরাষ্ট্রপতির স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পায় ।
1956 খ্রিঃ কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট এর প্রশংসাপত্র লাভ করে । এরপর 1966 খ্রিঃ পর্যন্ত পথের পাঁচালী বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্রোৎসবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছে ।
এরপর থেকে চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের জয়যাত্রা শুরু হয় । তার পরিচালিত প্রায় সবকটি ছবিতেই তার সৃজনশীল প্রতিভার বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটেছে ভারতীয় অন্য কোন ছবিতে ছিল দুর্লভ ।
বস্তুতঃসত্যজিৎ ভারতীয় চলচ্চিত্রের গােত্রান্তর ঘটিয়েছিলেন । তার পরিচালিত উল্লেখযােগ্য ছবি ‘ অপরাজিত , অপুর সংসার । জলসাঘর , কাঞ্চনজঙ্ঘা , অভিযান , মহানগর , চারুলতা এবং শেষ দিককার ঘরেবাইরে , গণশত্রু , শাখাপ্রশাখা , আগন্তুক প্রভৃতি ।
1977 খ্রিঃ পরিচালনা করেন প্রথম হিন্দিছবি শতরঞ্জকে খিলাড়ি । তার তৈরি তথ্যচিত্র হল রবীন্দ্রনাথ , সিকিম , সুকুমার রায় প্রভৃতি ।
1960 খ্রিঃ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় তার পিতামহ ও পিতার প্রিয় সন্দেশ পত্রিকা নতুন করে প্রকাশ শুরু করেন । সম্পাদনা ও অলঙ্করণের পাশাপাশি নিজেও লেখা শুরু করেন । এভাবেই একে একেসৃষ্টি হয় ফেলুদা , তপশে , জটায়ু , প্রফেসর শঙ্কুর মত বাঙালি শিশু – কিশােরদের প্রিয় কিছুসাহিত্যচরিত্র।
লিয়রের ছড়া অবলম্বনে পাপাঙ্গুল তার প্রথম রচনা । 1969 খ্রিঃ বাদশাহী আংটি প্রকাশিত হয় । সেই থেকে 1991 খ্রিঃ পর্যন্ত নয়না রহস্য তার সর্বশেষ বই প্রকাশিত হয় ।
সাহিত্যের আসরেও গল্পবলার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য অল্পসময়ের মধ্যেইসত্যজিৎ প্রশংসা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন । তার রচিত কয়েকটি উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ প্রােফেসর শঙ্কুর কান্ডকারখানা , সােনারকেল্লা , বান্মরহস্য , ‘ জয়বাবা ফেলুনাথ , গােরস্থানে সাবধান , যত কান্ড কাঠমান্ডুতে , তারিণী খুড়াের কীর্তিকলাপ , দার্জিলিং জমজমাট প্রভৃতি ।
1967 খ্রিঃ প্রফেসর শঙ্কু বছরের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য গ্রন্থরূপে আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে । সাহিত্যিক হিসেবে এছাড়াও তিনি আরও সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন ।
চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ দেশের ও বিদেশের বহু পুরস্কার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি . লিট উপাধি লাভ করেন । বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম সম্মান এবং ভারত সরকারের ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত হন ।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট সােয়া মিতের কলকাতায় এসে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লেজিয় দ’নর – এর স্বর্ণপদক প্রদান করেন । চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বোচ্চ পুরস্কার অস্কার লাভ করেন 1992 খ্রিঃ ।
1992 খ্রিঃ 23 শে এপ্রিল 71 বছর বয়সে প্রখ্যাত সাহিত্যিক , চিত্রশিল্পী , সঙ্গীত পরিচালক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় কলকাতায় পরলোক গমন করেন ।
শেষ কথা,
অবশেষে বলা যাই যে , সত্যজিৎ রায়ের জীবনী বিশ্লেষণ করলে আমার জানতে পারি যে বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের স্তর এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চালচিত্র নির্মাণ ছাড়াও তিনি ছোটদের গল্প তৈরিতে ও চিত্রকলায় প্রখর দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। ধন্যবাদ