গৌতম বুদ্ধ :- ষষ্ঠ শতকে যারা প্রতিবাদে ধর্মকে ভারত তথা বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গৌতম বুদ্ধ।
জন্ম :-
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের তরাই অঞ্চলের কপিলাবস্তু লুম্বিনী উদ্যানে শাক্য নামে এক ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্ব অথবা ৪৮০ অব্দ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শুদ্ধোধন এবং মাতা ছিলেন মায়াদেবী। গৌতম বুদ্ধের পিতা ছিলেন কপিলাবস্তুর রাজা। এবং মাতা ছিলেন কোলিয়গনের রাজকন্যা। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন সম্যকসম্বুদ্ধ (তপস্বী) ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী । গৌতম বুদ্ধ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা। আধ্যাত্মিক সাধনা ও জীবন নিয়ে নিজস্ব জ্ঞান-উপলব্ধির পর তিনি বুদ্ধ নামটি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সিদ্ধার্থ গৌতম,শাক্যমুনি বুদ্ধ বা "বুদ্ধ" উপাধি অনুযায়ী কেবলমাত্র বুদ্ধ নামেও পরিচিত ছিলেন।
◾গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী:-
শাক্য প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রধান ক্ষত্রিয় বংশের শুদ্ধোধনের পুত্র ছিলেন সিদ্ধার্থ গৌতম। শাক্যদের প্রথা অনুসারে গর্ভাবস্থায় মায়াদেবী শ্বশুরবাড়ি থেকে পিতৃরাজ্যে যাবার পথে অধুনা নেপালে তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত লুম্বিনী গ্রামে এক শালগাছের তলায় সিদ্ধার্থের জন্ম দেন। তাঁর পিতা সিদ্ধার্থের জন্মের পঞ্চম দিনে নামকরনের জন্য আটজন ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ জানালো। এবং তারা শিশুর নাম রাখেন সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ নামের অর্থ হল যিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। সিদ্ধার্থের জন্মের সপ্তম দিনে মায়াদেবীর মৃত্যু হয়। তারপর অসিত নামে পর্বতদেশ থেকে আগত একজন সাধু নবজাত শিশুকে দেখে ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, এই শিশু অর্থাৎ সিদ্ধার্থ পরবর্তীকালে একজন রাজচক্রবর্তী অথবা একজন সিদ্ধ সাধক হবেন। একমাত্র সর্বকনিষ্ঠ আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ কৌন্ডিণ্য স্পষ্টভাবে বলেছিলেন এই শিশু পরবর্তীকালে "বুদ্ধত্ব" লাভ করবেন। সিদ্ধার্থের মাতার মৃত্যুর পর বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতম অর্থাৎ তাঁর মাসি এর কাছে মানুষ হন।
সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তার পিতা-মাতা তাকে ১৬ বছর বয়সে কোলিয়গনের সুন্দরী এক কন্যা যশোধরার সাথে সিদ্ধার্থের বিবাহ দেন। এবং তারা রাহুল নামে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সিদ্ধার্থ তার জীবনের ২৯টি বছর প্রথমে রাজপুত্র হিসেবে অতিবাহিত করেন । "শুদ্ধোধন সিদ্ধার্থের জীবনে বিলাসিতার কোনোরকম ত্রুটি রাখেনি, সমস্ত রকম ব্যবস্থা করার সর্ত্ত্বেও সিদ্ধার্থ বস্তুগত ঐশ্বর্য - ধনসম্পত্তি যে জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না তা উপলব্ধি করা শুরু করেন।
মহাভিনিষ্ক্রমণ :-
বৌদ্ধ পুঁথিগুলিতে কথিত আছে ২৯ বছর বয়সে রাজকুমার সিদ্বার্থ প্রাসাদ থেকে কয়েক বার ভ্রমণে বের হলে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, একজন অসুস্থ মানুষ, একজন মৃত মানুষ ও একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণায় সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ সিদ্ধার্থ তাঁর সারথি ছন্নকে এদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে । এবং এইসবের অর্থ কি জানতে চায়। ছন্ন তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলে যে সকল মানুষের নিয়তি যে, তারা একসময় বৃদ্ধ, অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। মুণ্ডিত-মস্তক পীতবর্ণের জীর্ণবাস পরিহিত সন্ন্যাসী সম্বন্ধে ছন্ন তাকে বলল, যে মানুষের দুঃখের জন্য নিজ গার্হস্থ্য জীবন ত্যাগ করেছেন তিনিই সন্ন্যাসী। সংসার জীবনের দুঃখ, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর বিষয়গুলি গৌতম বুদ্ধকে খুব ভাবিয়ে তোলে বৌদ্ধধর্মে এই তিনটি বিষয়কে "ত্রিতাপ" বলে। এই সকল বিষয়গুলো থেকে সিদ্ধার্থ এক নতুন অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করে। এবং বিষাদগ্রস্ত সিদ্ধার্থ মানব জীবনের থেকে "ত্রিতাপের যন্ত্রনা" মোচনের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
বার্ধক্য,জরা এবং মৃত্যুকে জয় করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে একজন সন্ন্যাসীর জীবন-যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। হঠাৎ এক গভীর রাতে ঘুমন্ত স্ত্রীর পুত্র, সংসারের প্রতি বীতরাগ সিদ্ধার্থ পরিবারের সকলকে ছেড়ে নিঃশব্দে বিদায় জানিয়ে প্রিয় অশ্ব কন্থক ও সারথি ছন্নকে নিয়ে এই বিশাল বিলাস-ভবন প্রাসাদ ত্যাগ করেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বনের শেষ প্রান্তে গিয়ে তার পরনের থাকা রাজবস্ত্র তিনি ত্যাগ করেন এবং তলোয়ার দিয়ে তার লম্বা চুল কেটে মুণ্ডিত-মস্তক হন। কন্থক ও ছন্নকে বিদায় জানিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
গৌতম বুদ্ধের বোধিলাভ:-
গৌতম বুদ্ধ আলার কালাম নামে এক সন্ন্যাসীর কাছে প্রথমে যোগ শিক্ষা গ্রহণ করে কিন্তু তাতে তিনি তার প্রশ্নের যথাযথ সন্তোষজনক উত্তর লাভ না পাওয়ায় পরে তিনি উদ্দক রামপুত্ত নামে এক অন্য একটি সন্ন্যাসীর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে যোগ শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু সেখানেও তার জিজ্ঞাসা পূরণ না হওয়ায় গৌতম বুদ্ধ তাকেও ত্যাগ করেন। বুদ্ধগয়ার সামনেই উরুবিল্ব নামক এক রম্য জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। শারীরিক কষ্টপ্রদানের মাধ্যমে নাকি মুক্তিলাভ সম্ভব তিনি তা বিশ্বাস করতেন। এবং এই বিশ্বাসকেই ভিত্তি করে গৌতম বুদ্ধ সহ আরো পাঁচজন তপস্বী প্রায় ছয় বছর ধরে অনশন, শারীরিক নিপীড়ন ও কঠোরতম তপস্যার পর আস্তে আস্তে তার শরীর অস্থিচর্মসার হয়ে পড়ে ও তার অঙ্গ সঞ্চালনের ক্ষমতা কমে গিয়েছে এবং তিনি মরণাপন্ন হলে তার উপলব্ধি হয় যে, অনশন করে কিংবা শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ সম্ভব নয়।
ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্রানুসারে- অসংযত বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং কঠোর তপস্যার মধ্যবর্তী একটি মধ্যম পথের সন্ধান করে বোধিলাভ করা যায় বলে তিনি তখন তা উপলব্ধি করেন। এবং তিনি আবারও খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় । এক স্থানীয় গ্রাম্য সুজাতা নাম্নী নামে এক কন্যার কাছ থেকে তিনি এক পাত্রে পরমান্ন খান। গৌতম বুদ্ধকে আহার করতে দেখে তাঁর সঙ্গে থাকা বাকি পাঁচজন সাথী বুদ্ধের ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে একা ফেলে ছেড়ে চলে যান। এরপর গৌতম বুদ্ধ একটি অশ্বল্থ গাছের তলায় ধ্যান শুরু করে এবং প্রতিজ্ঞা করে যে সত্য লাভ না করা অবদি স্থান ত্যাগ করবেন না। এরপর তিনি ৪৯ দিন ধরে ধ্যান করার পরে অবশেষে বোধিলাভ করে। বোধি প্রাপ্ত গৌতম বুদ্ধ তখন মানব জীবনের দুঃখ ও তার কারণ এবং দুঃখ নিবারণের উপায় সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন,যা চতুরার্য সত্য নামে খ্যাত হয়। গৌতম বুদ্ধের মতানুসারে এই সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ সম্ভব।
গৌতম বুদ্ধের ধর্মপ্রচার:-
বোধিলাভের পর বলখ অঞ্চলের তপুস্স ও ভল্লিক নামে দুইজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের দেখা হয়। যারা গৌতম বুদ্ধকে মধু ও বার্লি নিবেদন করেন। এই দুইজন ছিলেন বুদ্ধের প্রথম শিষ্য। প্রাক্তন শিক্ষক আলাম কালাম ও উদ্দক রামপুত্তের সাথে দেখা করে গৌতম বুদ্ধ তাঁর এই নবলব্ধ জ্ঞানের কথা বলার জন্য অনেক উৎসাহী ছিলেন।
কিন্তু পরে জানতে পারে তার প্রাক্তন দুই শিক্ষক আর বেঁচে নেই। এরপর তিনি বারানসীর নিকট ঋষি পতনের মৃগ উদ্যানে যাত্রা করেন, তাঁর প্রাক্তন পাঁচ সঙ্গী যারা একসময় তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে। গৌতম বুদ্ধ সাক্ষাৎ করার পর তার পাঁচ সঙ্গীকে প্রথম শিক্ষা প্রদান করেন। যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে পরিচিত। ঠিক এইভাবে পাঁচ সঙ্গীকে ঘিরে ইতিহাসে প্রথম বৌদ্ধ সংঘ গঠিত হয়।এরপর মহাকশ্যাপ নামে অগ্নি উপাসক ব্রাহ্মন তাঁর অনুগামীরাও সংঘ যোগ দেন। বুদ্ধ সম্রাট বিম্বিসারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো বুদ্ধ প্রাপ্তির পরে রাজগৃহে যাত্রা করলে সঞ্জয় বেলাট্রিপুত্তের দুইজন শিষ্য সবিপুও ও মৌদগল্যায়ন সংঘে যোগদান করেন৷ গৌতম বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোধন প্রায় বুদ্ধত্ব লাভের এক বছর পর তাঁর ছেলেকে কপিলাবস্তু শহরে আমন্ত্রণ জানান৷ গৌতম বুদ্ধ সংঘের সাথে ভিক্ষা করে খাদ্য সংগ্রহ করতেন৷ কপিলাবস্তুর তাঁর পুত্র রাহুল তাঁর কাছে শ্রমনের দীক্ষা নেয়। এবং তাঁর সাথে আরো দুইজন আত্মীয় ঘথা আনন্দ ও অনুরুদ্ধ তার কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন৷ এই সকল শিষ্য ছাড়াও গৌতম বুদ্ধের উপলি, মহাকাত্যায়ন, পুন্ন ও সুভূতি বুদ্ধের দশজন প্রধান শিষ্য ছিলেন৷
তিন বছর পরে শাক্যদের সাথে কোলীয় গনের রোহিনী নদীর অংশ নিয়ে একটি বিবাদ তৈরী হলে বুদ্ধ তাঁর মীমাংসা করেন৷ কয়েকদিন পর তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করে। তারপর তাঁর বিমাতা মহাপজাপ্রতি গোতমী সংঘে যোগদানের ইচ্ছার কথা বলেন৷ প্রথমে বুদ্ধের নারীদের সংঘে যোগদানের বিষয়টি তেমন ভাবে মেনে নেননি কিন্তু পরে আনন্দের উৎসাহে বুদ্ধ সংঘ গঠনের ঠিক পাঁচ বছর পরে নারীদের ভিক্ষুনী হিসেবে প্রবেশের অনুমতি দেন। এই ভাবেই গৌতম বুদ্ধের ধর্মপ্রচার সারা বিশ্বে ছরিয়ে পরে।
মহাপরিনির্বাণ বা মৃত্যু :-
মহাপনিব্বান সুও অনুসারে - গৌতম বুদ্ধের বয়স যখন প্রায় আশি, সেইসময় তিনি তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেন৷ পাওয়া নামক এক জায়গায় থাকাকালীন চন্ড নামক এক কামার গৌতমবুদ্ধকে ভাত ও শূকরমদ্দক ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের খাবার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান৷ সেই সব খাবার পর আমাশয় দ্বারা আক্রান্ত হন৷ চন্ডের দেওয়া খাবার যে তাঁর অসুস্থতার কারণ নয়, আনন্দ যাতে তা চন্ডকে বোঝান, এমনটা বৌদ্ধ অনন্দকে নির্দেশ দেন৷ খুব শরীর খারাপ নিয়েও বুদ্ধ কুশীনগর রওনা হয় আনন্দ বাধা দিলেও গৌতম তার কোনো কথায় শোনেননি৷ এবং অনন্দকে এইখানে নির্দেশ দেন দুইটি শাল বৃক্ষের মধ্যের একটি জমিতে একটি কাপড় বিছিয়ে তাকে যেন শুইয়ে দেওয়া হয়৷ এরপরে শায়িত অবস্থায় বুদ্ধ উপস্থিত সকল ভিক্ষু ও সাধারণ মানুষকে তাঁর শেষ উপদেশ প্রদান করেন। তাঁর জীবনের শেষ বানী ছিল "বয়ধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা" অর্থাৎ "সকল জাগতিক বস্তুর বিনাশ আছে। অধ্যবসায়ের সাথে আপনার মুক্তির জন্য সংগ্রাম কর৷" বিভিন্ন পুঁথিতে অনুবাদ বিভ্রাট ও লিখন শৈলীর পার্থক্যের জন্য গৌতম বুদ্ধের অন্তিম আহার্য্য বস্তু সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায় না।
শূকরমদ্দক শব্দটিকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন অর্থ দিয়েছেন যেমন-
আর্থার ওয়েলির মতে - থেরবাদ ঐতিহ্যনুসারে শুকরমদ্দভ বলতে শূকরের নরম মাংস বোঝানো হয়।
কার্ল ইউজিন মিউম্যান - এই শব্দের অর্থ করেছেন শূকরের নরম আহার৷ এবং নিউম্যান ও ওয়েলি - আবার বলেছেন যে এই আহারের সাথে শূকর শব্দটি যুক্ত হলেও হয়তো এটি একটি শুধুমাত্র একটা উদ্ভিদ, যাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে কয়েক শতাব্দী পর গৌতমবুদ্ধের জীবনী রচনার সময় শূকরমদ্দভ কথাটি অর্থ শূকরের নমর মাংস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
অস্কার ভন হিনুবারের মতে, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু খাদ্যের বিষক্রিয়ার কারনে হয়নি, বরং সুপিয়িয়র মেসেন্ট্রিক আর্টারি সিনড্রোম নামক বার্ধ্যকের সময়ের একটি রোগের কারণে হয়েছিল।
দীপবংশ ও মহাবংশ নামে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থানুসারে , গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ২১৮ বছর পরে সম্রাট অশোকের রাজ অভযেক হয়। এই দিকটি বিচার করলে দেখা যায় ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয়।
অপরদিকে চীনা পুথিঁগুলিতে নজর দিলে লক্ষ্য করা যায় - গৌতম বুদ্ধের ১১৬ বছর পরে আশাকের রাজ্যাভিষেক হয়, সেই অনুসারে বিচার করলে ৩৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বুদ্ধের মৃত্যু হয়। যাইহোক - থেরবাদ বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ৫৪৪ বা ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ ঘটে বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। এবং মায়ানমারের ৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ১৩ই মে ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরা ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ১৩ই মার্চ বুদ্ধের মৃত্যুদিবস বলে মনে করা হয়।
গৌতম বুদ্ধের ঐতিহ্যশালী জীবনীগ্রন্থ :-
বিভিন্ন ঐতিহ্যশালী জীবনীগ্রন্থ গুলি বুদ্ধের জীবনের মূল উৎস ছিল৷ "ত্রিপিটক" বুদ্ধ বংস নামক গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধের জীবনী পাওয়া যায়। "ত্রিপিটক'' শব্দের অর্থ তিনটি পেটিকা বা খন্ড৷ তিনটি খন্ডে বিভক্ত বলে এর নাম হয়েছে "ত্রিপিটক।" এই ত্রিপিটক এর মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের ধর্ম, দর্শন , বাণী ও উপদেশ। এই ত্রিপিটকের তিনটি খন্ড হচ্ছে-
পালি ত্রিপিটক যেহেতু বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর হতে সংকলিত হয়েছে তাই এই গ্রন্থের সত্যতা মেনে নিলেও ভুল হবে না৷ তথাগত বুদ্ধ নিজেই এই গ্রন্থেরবর্ণনা প্রকাশ করেছেন৷ অশ্বঘোষ দ্বারা রচিত দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত বুদ্ধচরিত নামক মহাকাব্যটি বুদ্ধের প্রথম পূর্ণ জীবনী গ্রন্থ। ত্বতীয় শতকে রচিত হয় ললিতবিস্তার সূত্র বুদ্ধের জীবনী নিয়ে লিখিত পরবর্তী গ্রন্থ। এবং চতুর্থ শতাব্দীতে মহাসাংঘিক রচিত লোকোত্তর বাদ ঐতিহ্যের মহাবস্তু গ্রন্থটি অপর একটি প্রধান জীবনীগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়। ধর্মগুপ্তক রচিত তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ঐতিহ্যের অভিনিস্ক্রমণ সূত্র গ্রন্থটি বুদ্ধের একটি বিরাট জীবনীগ্রন্থ ছিল। সর্বশেষে পঞ্চম শতাব্দীতে বুঘঘোষ রচিত থেরবাদ ঐতিহ্যের নিদানকথা উল্লেখ্য৷ ত্রিপিটকের অংশ হিসেবে জাতক মহাপদন সূত্র ও আচরিয়াভূত সূত্রে বুদ্ধের সম্পূর্ণ জীবনী না থাকলেও কিছু নির্বাচিত অংশ রয়েছে। ইত্যাদি গ্রন্থে বুদ্ধকে লোকোত্তর সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে৷ ভারতীয়রা প্রাচীন যুগের ইতিহাস ও কালপঞ্জীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন, বরং তারা দর্শনের ওপর বেশি মনোযোগী ছিলেন। বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে এই ধারার চিত্র লক্ষ্য করা যায়।
◾ গৌতম বুদ্ধের অহিংসা নীতি :-
তথাগত ভগবান বুদ্ধ ছিলেন সমস্ত প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে৷ অহিংসা কথার অর্থ হল হিংসা ত্যাগ করা৷ বৌদ্ধমতে অহিংসা কথার অর্থ বলতে বোঝায় কায়-মন-বাক্যে হিংসা বর্জন করা। কারো অনিষ্ঠ না করা৷ প্রানিহত্যা থেকে শত শত হাত দূরে থাকা ও সকল জীবকে রক্ষা করা, মানবতা, কোমলতা, দয়া, করুনা ইত্যাদি৷ বুদ্ধ বলেছিলেন - " কেবলমাত্র নিজেকে ভালোবাসলে হবে না, ভালোবাসতে হবে সমস্ত জীবকে ৷ বুদ্ধ এমন অহিংসবাদী নীতি প্রবর্তন করেছিলেন ৷
বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহনেচ্ছায় কোনো ব্যক্তি যদি বুদ্ধের কাছে আসতেন, তিনি তাকে সর্বপ্রথম পাঁচটি বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করাতেন৷ সেই পাঁচটি বিষয় বৌদ্ধ ধর্মের মতানুসারে "পঞ্চশীল" নামে পরিচিত ছিল৷ প্রথম শীলটি ছিল - "প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা৷" এই বাক্যটির থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে একজন বৌদ্ধ হতে হলে কেবলমাত্র মানুষের প্রতি ভালোবাসা মৈত্রী ও করুনার চর্চা থাকলেই হবে না সমানভাবেই জীবের প্রতি মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শন অবশ্যই থাকা উচিত৷ এই প্রসঙ্গে বলতে শোনা যায় - "সকলেই দন্ডকে ভয় করে, জীবন সকলের প্রিয়, মৃত্যুর ভয়ে সকলেই সন্ত্রস্ত, সুতরাং নিজের সাথে তুলনা করে কাউকে প্রহার কিংবা আঘাত করো না৷
ধর্ম প্রবর্তকদের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধ এবং জৈন ধর্মের স্বপ্নদ্রষ্টা মহাপুরুষ মহাবীরকে প্রাণীর প্রতি এতটা সহনশীল হতে দেখা যায়। অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রবর্তকদের মধ্যে এমনটা দেখা যায় না। উল্টে তারা তাদের অনুসারীদের- প্রাণীদেরকে হত্যা এবং প্রাণীদের মাংস ভক্ষণ ও উপভোগ করতে উৎসাহ দেয়, এর ফলে সেই সমস্ত ধর্মগুরুরা প্রাণীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও শুভকামনা থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে করা হয়। বুদ্ধ অহিংসানীতির চরমে পৌঁছেছিলেন, তার মতে প্রানীরও প্রাণ আছে। বুদ্ধ বলেন,নদী কিংবা সমুদ্রের উপর জাহাজ কিংবা নৌকা চালানোও এক ধরনের পাপ। তিনি আরোও বলেন, আমাদের নিঃশ্বাসের আদান-প্রদানের মাধ্যমে যেহেতু ছোট ছোট পোকা মাকড়াদি মারা যায়। তাই আমাদের উচিত আমাদের নাকে একটি ছোট কাপড় দিয়ে ঢেকে নিঃশ্বাস নেওয়া।
মহাকরুনিক বুদ্ধের শিক্ষা হচ্ছে মধ্যম পথের অবলম্বন করা। অতএব বুদ্ধকর্তৃক সর্বপ্রকার চরমপন্থা পরিহৃত হয়েছে। ফলে যে কোন ব্যক্তি যে কোন জায়গায় এই ধর্মমত পালন করতে পারে। বুদ্ধের মত যেকোন প্রাণীর জীবন- সে বন্ধুত্বপূর্ণ হোক বা অবন্ধুত্বপূর্ণ, ছোট কিংবা বড়ো, পরিচিত কিংবা অপরিচিত, দৃষ্ট অথবা অদৃষ্ট, ঐ নির্দিষ্ট প্রাণীর নিকট অতীব প্রিয়। খন্ধ পরি ওং এ বুদ্ধ বলেন- "পদহীনের সহিত আমার মৈত্রী হোক ও বহুপদের সহিতও আমার মৈত্রীভাব হোক।সকল সত্ত্ব, সকলজীব, মঙ্গল দর্শন করুক, কেহ কোন প্রকার অমঙ্গল প্রাপ্ত যেন না হয়। বুদ্ধ সমস্ত প্রাণীর প্রতি এমন ভাবেই শ্রেয় ও যত্নশীল মৈত্রী প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। বৌদ্ধশিক্ষায় বুদ্ধ এমন কোনো কথা বলেননি যা অন্য কোন প্রাণীর জন্য কিঞ্চিত পরিমানও ক্ষতিকর কিংবা দুঃখজনক হয়। তিনি তাঁর শিষ্যদের এমন অমানসিকতা হিংসাপরায়ণ এমন কোন শিক্ষা দেননি যাতে গোপনেও কারো কোন ক্ষতি কখনো হতে পারে।
কাকাচুপম সূত্রে ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন,- হে ভিক্ষু যদি হিংস্র দুর্বৃজ্ঞান কোন ব্যক্তিকে দুই- হাতল বিশিষ্ট করাত দিয়ে টুকরো টুকরোও করেন, এবং সেই ব্যক্তির মনে ঐ দুর্বৃত্তদের প্রতি এত টুকু পরিমাণ হিংসাভাবও যদি জন্মে থাকে তাহলে মনে করা হবে, সেই ব্যক্তিটি আর যাই হোক না কেন সে আমার ধর্মের প্রকৃত অনুসারী নয়। হে ভিক্ষুগণ, এমনকি সেরকম তোমরা দৃঢ়তার সহিত এইরূপ চিন্তা করবে যে, আমাদের মন কোনো অবস্থাতেই কখনো পাল্টাবে না। আমরা তাদেরকে কোন ধরনের বাজে কথা বলব না। বরং তাদেরকে ভালোবাসবো। আমরা আমাদের মৈত্রী চিন্তাধারার ব্যাপকতায় সমস্ত পৃথিবীর প্রাণীদের প্রতি অপরিসীম করুণা প্রসারিত করবো। এমনকি সে যদি আমাদের পরম শত্রুও হয় তবুও তাদের প্রতি আমরা মৈত্রী প্রদর্শনের চিন্তা করতে অভ্যস্ত থাকবো।
বুদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হতে হলে প্রথমে একজন ব্যক্তি যে শিক্ষা পান তা হলো- কোন অবস্থাতে কোন প্রাণীর প্রতি কোনো রকমের ক্ষতি করা যাবে না। এবং দুঃখ প্রদান করা যাবে না। এ থেকে বোঝা যায় বুদ্ধ হচ্ছেন একজন প্রকৃত অহিংসানীতির প্রবক্তা। কোন যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে অর্থাৎ যেখানে হত্যা, ধ্বংস, আঘাত কিংবা দুঃখের কার্য্যাদি সম্পাদিত হয়ে থাকে সেখানে বৌদ্ধদের মধ্যে যারা বুদ্ধের প্রকৃত ভক্ত- তারা কখনোই এই ধরণের যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না৷ প্রাণীর প্রতি যারা সত্যিই মন থেকে মৈত্রী প্রদর্শনে সর্বদা রত থাকেন তারাই হচ্ছেন প্রকৃত বৌদ্ধ৷
বুদ্ধের এই অহিংসানীতির পথ ধরেই সম্রাট অশোক চন্ডাশোক থেকে পরিবর্তন হয়েছিলেন ধর্মাশাকে৷ এমনকি শ্রীলংকার ধর্মপ্রাণ রাজা সিরিসংযবো, ভারতে মহাত্মাগান্ধি ও জওহরলাল নেহরু তাঁদের অহিংসানীতির কারনে চিরকাল অমর হয়ে থেকেছেন ইতিহাসের সমস্ত পাতায়৷
গৌতম বুদ্ধের এই অহিংসানীতি কোনো সমাজ, জাতি, কিংবা রাষ্ট্রের মাধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা হওয়া চাই বৈশ্যিক এবং সর্বকালিক তাহলেই গড়ে উঠবে পৃথিবীতে আবারও শান্তির নীড়-মানুষ তথা প্রাণীগণ উভয়েই খুঁজে পাবে জীবনের নিরাপত্তা৷ আজকের এই অরাজকতার যুগে যখন মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে ভেদাভেদ নেই, তখন বুদ্ধের এই মহামূল্যবান ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম৷
◾ গৌতম বুদ্ধের অমৃত বাণী, উক্তি, ও উপদেশ :-
গৌতম বুদ্ধের জীবন ছিল বিভিন্ন শিক্ষনীয় ঘটনা দ্বারা সমন্বিত। তিনি ছিলেন একজন তপস্বী। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ মানব সভ্যতার একজন ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ মানব জীবনের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায়ের জন্য তিনি তার অনুগামীদের জন্য কিছু জীবনের পথ নির্দেশিকা দেন। তিনি বলেন নির্বাণ লাভ কিংবা কামনা-বাসনা থেকে মুক্তিলাভের মাধ্যমেই দুঃখের অবসান ঘটে। এর মধ্যে দিয়েই অজ্ঞানতা দূর হয়ে মেলে পূর্ণ শান্তি। আজ হিংসায় ঘেরা উন্মত্ত পৃথিবীতে জীবন, সুখ, শান্তি, প্রেম- ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, ধ্যান, আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান, অনুপ্রেরণা ইত্যাদির ওপর বলা গৌতম বুদ্ধের উক্তি বা বাণী গুলো মানুষকে সঠিক পথ অনুসন্ধান দিতে পারে। গৌতম বুদ্ধের জীবন বদলে দেওয়া অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি বা বাণী গুলি হলো:-
জীবন নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি :-
শত্রু নিয়ে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন:-
গৌতম বুদ্ধের অনুপ্রেরণামূলক উক্তি ও বাণী:-
গৌতম বুদ্ধের ধর্মীয় উক্তি:-
গৌতম বুদ্ধের ধর্মের ব্যাপার উদারপন্থী ছিলেন।
পাপ নিয়ে গৌতম বুদ্ধের বাণী :-
সুখ ও শান্তি নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি:-
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি:-
◾বন্ধু নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি:-
রাগ নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি:-
◾সত্য নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি:-
◾ব্যাথা, রাগ, দুঃখ নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি:-
◾মন নিয়ে গৌতম বুদ্ধের উক্তি :-
◾গৌতম বুদ্ধের উপদেশ বাণী :-