দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। বাংলার আধুনিক নাট্যধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র অবশ্য মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারায় দীনবন্ধু মিত্রই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের নাট্যকারদের আদর্শস্থানীয়।
দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম ও পরিবার:
দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম উত্তর ২৪ পরগণা জেলার চৌবেরিয়ায়। যে সময় দীনবন্ধু মিত্র জন্মগ্রহণ করেন উত্তর ২৪ পরগণা জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে, সে সময় এই স্থানটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অংশ ছিল না, এটি নদীয়া জেলার অংশ ছিল। এই চৌবেড়িয়া গ্রামের চারদিক নদী বেষ্টিত ছিল, তাই এই স্থানের নাম চৌবেড়িয়া। তার পিতামাতা তার নাম রেখেছিলেন গন্ধর্ব নারায়ন মিত্র। পিতামাতার মনে স্বপ্ন ছিল, এই মানুষটি একদিন কিছু অসম্ভব কাজ করবেন এই হতদরিদ্র গ্রামের মানুষের জন্য, এই বাংলার মানুষের জন্য।পিতা হলেন কালাচাঁদ মিত্র। দরিদ্র পরিবারে জাত দীনবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম্য পাঠশালায়। সেখানে কিছুদিন পাঠগ্রহণের পর তার পিতা তাকে জমিদারের সেরেস্তার কাজে নিযুক্ত করে দেন।
দীনবন্ধু মিত্রের শিক্ষাজীবন:
দীনবন্ধু মিত্র বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাই তিনি কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং পিতৃব্যের গৃহে বাসন মেজে লেখাপড়া চালিয়ে যান। এই সময়েই দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করে জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলের শেষ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করে হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৫১ সালে আবার উচ্চতর পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ করেন এবং ১৮৫২ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকে সিনিয়র বৃত্তিলাভ করেন। প্রত্যেক পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনিই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর সম্ভবত কোথা ও শিক্ষকতা করেছিলেন দীনবন্ধু, কারণ ১৮৫৩ সালে তিনি টিচারশিপ একজামিনেশনে কৃতকার্য হয়েছিলেন।কলেজের সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে।
দীনবন্ধু মিত্রের কর্মজীবন:
ছাত্রাবস্থায় দীনবন্ধু মিত্র কবিতা লেখা শুরু করেন। সেইসূত্রে কবিঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গেতার পরিচয় হয় এবং তিনি তাঁর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন । ঈশ্বরগুপ্তের শিষ্যদের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্রই সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। দীনবন্ধু মিত্র ১৮৫৫ সালে ১৫০টাকা বেতনে পটনায় পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। ক্রমে তার পদোন্নতি হয় এবং তিনি ওড়িশা, নদিয়া ও ঢাকা বিভাগে এবং পরে কলকাতায় সুপারিনটেন্ডেন্ট পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। লুসাই যুদ্ধের সময় ডাকবিভাগের কাজে তিনি কাছাড়ে প্রেরিত হন। এই সময় তার তদারকি কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার তাকে রায়বাহাদুর উপাধি দান করেন। যদিও ডাকবিভাগের উচ্চস্তরের কর্মচারী হয়েও উপযুক্ত বেতন তিনি পাননি।
দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম কবিতা:
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় “ ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যশিষ্যদের মধ্যে দীনবন্ধু উরুর যতটা কবি – স্বভাবের উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন , এতয়ার কেহনহো দীনবন্ধুর হাস্যরসে যে অধিকার , তাহা গুরুর অনুকার …। ‘ ঈশ্বরচন্দ্র সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ সাধুরঞ্জন ‘ পত্রিকায় দীনবন্ধুর প্রথম কবিতা ‘মানব – চরিত্র ‘ প্রকাশিত হয়।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যকার রূপে আবির্ভাব :
গল্প , কবিতা , উপন্যাস রচনায় সিদ্ধহস্ত হলেও দীনবন্ধু মিত্র মূলতঃ নাট্যকার হিসাবে দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাবের ফলে সাধারণ রঙ্গালয়ের দ্বারােন্মােচন সহজে সম্ভব হয়ে ওঠে । শুরু হয় বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নতুন অধ্যায় । বাংলা নাটকরাজপ্রাসাদ থেকেমুক্তিলাভ করে চলে আসে খেটে খাওয়া মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে । নাট্য ইতিহাসে এই বিপ্লব ঘটে ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে ।
দীনবন্ধু মিত্রের রায়বাহাদুর উপাধি:
বাগবাজার এ্যামেচার থিয়েটার ন্যাশনাল থিয়েটার ’ নাম ধারণ করে রায়বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্র বিরচিত বিখ্যাত নাটক ‘ নীলদর্পণ ” মঞ্চস্থ করে ঐ তারিখে । ‘ নীলদর্পণ ’ মঞ্চস্থ করে ন্যাশনাল থিয়েটার যে জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করে তা বাংলা নাট্যরচনা ও মঞ্চচর্চাকে বিশেষ ও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও উৎসাহিত করতে সমর্থ হয় । উল্লেখ্য , ইংরেজ সরকার দীনবন্ধু মিত্রকে ১৮৭১ সালে । রায়বাহাদুর ’ উপাধি প্রদান করে।
” নীলদর্পণ ” বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে আজো বিবেচিত ও সমাদৃত । নীলকরদের বীভৎস অত্যাচার ও নির্যাতনে লাঞ্ছিত অপমানিত দেশবাসী ও চাষীদের দুরবস্থার এই নাটক তিনি লেখেন ১৮৬০ সালে ।
বাংলাদেশে বহুবার বহু মঞ্চে নাটকটি অভিনীত হয়েছে এবং হচ্ছে । নাটকটির আবেদন চিরায়ত । তার রচিত অন্য দুটি নাটক ‘ সধবার একাদশী ’ ‘ জামাইবারিক উচ্চাঙ্গের সামাজিক নাটক । ১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘ নীলদর্পণ ‘ – এর ইংরেজি Indigo Planting Mirror .
” অনুবাদ করেন । ইংরেজি অনুবাদের নাম ” NilDarpan or The হয়রারুদ্ধহন।বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন — ইতাছের জন্য লং সাহেব । নীলদর্পণ প্রচারের জন্য লংসাহেবসুপ্রিম কোর্টের বিচারে দন্ডীয় । থাকার নিমিওহউক , নীলদর্পণ ইউরােপের অনেক ভাষায় অনুবাদিত বিশেষ গুণ কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন বলিয়াই হউকঅথবা ইহার কোন ও পঠিত হইয়াছিল । এই সৌভাগ্য বাংলায় আর কোন গ্রন্থেই ঘটে নাই ।
দীনবন্ধু মিত্রের আরোও উল্লেখযোগ্য নাটক গুলি :
দীনবন্ধু মিত্র তার আরাে যে – সব নাটকে সমকালীন রুচি ও জীবনবােধের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তােলার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার মধ্যে নবীন তপস্বিনী , বিয়েপাগলা বুড়াে , সধবার একাদশী , লীলাবতী , জামাই বারিক , কমলে কামিনী বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু:
এই মহান নাট্যকার ১৮৭৩ সালের ১ লা নভেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
-ধন্যবাদ