অমর কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত প্রকৃতি তন্ময়মূলক গল্প ও উপন্যাসের এক মহান রূপকার।তার সৃজনশীল সাহিত্য প্রতিভার অন্তরালে ছিল একটি অনুভবী এবং সংবেদনশীল মন যার সাহায্যে তিনি প্রকৃতির রঙ্গশালায় ঘটে যাওয়া এক একটির ঘটনার অসামান্য বিবরন প্রদান করে তাঁর সাহিত্য সম্ভারকে অন্যতর ভূমিকায় উদ্ভাসিত করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন জনপ্রিয় ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অতি পরিচিত নাম। তাঁর লেখা পথের পাচাঁলী এবং চাঁদের পাহাড় উপন্যাস দুটি আজও সকল বাঙালীর মন কাড়ে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম:
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 1894 খ্রিঃ 12ই সেপ্টেম্বর কাচড়াপাড়ার সমীপবর্তী ঘােষপাড়া – মুরাতিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার:
পিতার নাম মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। তাদের আদি নিবাস ছিল যশাের জেলার (বর্তমান চব্বিশ পরগনা জেলার) অন্তর্ভুক্ত বনগ্রাম মহকুমায় অবস্থিত ইচ্ছামতী নদীতীরস্থ ব্যারাকপুর গ্রামে। তার পিতা কথকতা ও পৌরােহিত্য করতেন। ফলে বাল্য ও কৈশাের কাটে দারিদ্র্য, অভাবে ও অনটনের মধ্যে। বিভূতিভূষণ দুই ভাই এবং তিন। বােনের মধ্যে ছিলেন সবার বড়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব জীবন:
বাংলার পল্লীর অপরূপ সৌন্দর্য বিভূতিভূষণকে শৈশব থেকেই মুগ্ধ করত। ফলে অতি অকিঞ্চিৎকর লতা – গুল্ম, ফুল – পাতা, পাখি। – প্রকৃতির বুকের নিভৃতে লালিত প্রতিটি জীবনকে অতি নিবিড় ভাবে দেখার ও জানার সুযােগ পান। পরবর্তী কালে এই প্রকৃতি পাঠের বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতা নানাভাবে তার রচনাকে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন:
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন 1914 খ্রিঃ বনগ্রামের হাইস্কুল থেকে। কলকাতার রিপন কলেজ থেকে 1916 খ্রিঃ আই.এ ও 1918 খ্রিঃ ডিস্টিংশন নিয়ে বি.এ. পাশ করেন ।
উচ্চতর পড়াশােনার জন্য এম. এ. ও ল ’ ক্লাশে ভর্তি হন। কিন্তু সংসারের প্রবল চাপে পরে পড়া বন্ধ রেখে চাকুরি নিতে বাধ্য হন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলেজ জীবন:
কলেজে বি.এ. তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময় বিভূতিভূষণের সঙ্গে বসিরহাটের মােক্তার কালীভূষণ মুখােপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর বিবাহ হয়। কিন্তু বিয়ের অল্পকাল পরেই গৌরীদেবীর অকালমৃত্যু ঘটে। এই দুর্ঘটনার বহুদিন পরে ৩ রা ডিসেম্বর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছয়গাঁও নিবাসী যােড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা রমাদেবীকে তিনি বিবাহ করেন। এই দ্বিতীয় বিবাহ বিভূতিভূষণের সাহিত্য জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মজীবন:
কর্মজীবন শুরু করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকুরিতে। প্রথমে হুগলী জেলার জঙ্গীপাড়া গ্রামের স্কুলে। পরে সােনারপুর হরিণাভি স্কুল এবং পরে কলকাতার খেলাতচন্দ্র মেমােরিয়াল স্কুলে।
হরিনাভি স্কুল থেকে নতুন স্কুলে চাকুরি নেবার আগে মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কোনােরাম পােদ্দারের গােরক্ষিনী সভার প্রচারের কাজ করেন । তারপর খেলাতচন্দ্রের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতার সূত্রে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি ও পরে ভাগলপুর জমিদারীতে নায়েব তহশিলদারের কাজ করেন । ভাগলপুর শহরে বসবাস করতে থাকেন। এইভাগলপুর প্রবাস কালেইতার অমর উপন্যাস ‘ পথের পাঁচালী রচিত হয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প:
প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘ উপেক্ষিত ‘ , ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় মাঘ সংখ্যায় ছাপা হয় । প্রথম উপন্যাস ‘ পথের পাঁচালী ‘ । প্রকাশিত হয় ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে । প্রথম উপন্যাসই তাকে শক্তিশালী কথা সাহিত্যিকের প্রতিষ্ঠা এনে দেয় । এরপর সাহিত্যচর্চার দীর্ঘ একুশ বছরের পরিসরে তিনি বহু উপন্যাস , ছােটগল্প , ভ্রমণকাহিনী এবং শিশু – সাহিত্য রচনা করেন ।
বাংলার পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে গ্রাম্য – জীবনের দুঃখ , দারিদ্র্য , স্বপ্ন , আশা , প্রেম , ভালবাসার্তার রচনায় অপরিসীম দরদের সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে । কেবল পল্লীপ্রকৃতিই নয় , তার রচনায় অরণ্য ধরা পড়েছে । তার সমস্ত রহস্যময়তা , প্রাণােচ্ছল সজীবতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে। এক ভাবুক কবির দৃষ্টিতে দেখা অরণ্য প্রকৃতির এক অপরিচিত লীলায়িত রূপ বিধৃত হয়েছে তার বিখ্যাত ‘ আরণ্যক উপন্যাসে।
বিভূতিভূষণের সাহিত্যে ব্যক্তিজীবনের প্রভাব থাকলেও ভারতীয় অধ্যাত্মবােধ ও তার সীমাহীনতার স্পর্শ প্রায় প্রতিটি লেখাকেই সঞ্জীবিত করেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস:
দীর্ঘ একুশ বছরে সাহিত্যজীবনে গল্প , উপন্যাস , দিনলিপি , শিশুসাহিত্য মিলিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘ অপরাজিত ইসর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় গ্রন্থ:
বিভূতিভূষণের রচিত উল্লেখযােগ্য অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে , ইচ্ছামতী , দেবযান , আদর্শ হিন্দুহােটেল , বিপিনের সংসার , মেঘমল্লার , মৌরীফুল , যাত্রাবদল , দৃষ্টিপ্রদীপ প্রভৃতি ।
অনেক ক্ষেত্রে রােমাঞ্চক স্থানে ভ্রমণের মনােজ্ঞ কাহিনী তিনি । বর্ণনা করেছেন তার বনে পাহাড়ে ও ‘ হে অরণ্য কথা কও ‘ নামক গ্রন্থদ্বয়ে এবং তার দিনলিপি জাতীয় গ্রন্থাবলীতে । কিশােরদের জন্য লিখেছেন মিমিদের কবচ , মরণের ডংকা বাজে , হীরা মানিক জ্বলে , চাদের পাহাড় প্রভৃতি ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পুরস্কার:
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ইংরাজি ও ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে । মৃত্যুর পরে ইচ্ছামতী উপন্যাসের জন্য তাকে রবীন্দ্র পুরস্কারে । ভূষিত করা হয়। জীবনের শেষ দশ বৎসর বিভূতিভূষণ তাঁর অতি প্রিয় পিতৃভূমি । ব্যারাকপুরে বাস করেছিলেন । অবশ্য একটানা নয় । মাঝে মধ্যেই তিনি ঘাটশিলায় গিয়ে থেকেছেন । এই সময়ে তিনি অজস্র শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের সাহিত্য সৃষ্টি করেন । অনেকগুলি কালােচিত উপন্যাস ও বহু সার্থক রসােত্তীর্ণ ছােট গল্প এই সময়েই রচিত হয় । জীবনের প্রায় শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সাহিত্য – সাধনায় ব্রতী ছিলেন ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মৃত্যু:
1950 খ্রিঃ 1লা নভেম্বর, ঘাটশিলায় স্বগৃহে এই কালােজয়ী। ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ 56বছর বয়সে পরলােক গমন করেন।
-ধন্যবাদ