বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি তারা। তিনি তার রচনাশৈলী দিয়ে যেমন একদিকে বাংলা সাহিত্যকে নতুন উচ্চতাতে নিয়ে গেছেন ঠিক তেমনি তিনি বন্দে মাতরমের মতো মহান ও অমর রচনা দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন জীবন দিয়েছিলেন। আজ তার জন্মদিনের বিশেষ উপলক্ষে আমরা আপনাদের সামনে তার জীবন কাহিনীটি তুলে ধরতে চলেছি।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শৈশব বেলা থেকেই পড়াশোনার দিকথেকে প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র একদিনের মধ্যেই বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা কাঁঠালপাড়া গ্রামে শুরু হলেও তা সেখানে সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি কাঁঠালপাড়া গ্রামে আট দশ মাস পড়াশোনা করার পর বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মেদিনীপুরে চলে আসেন এবং মেদিনীপুরেই তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
মেদিনীপুরে ৫ বছর ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করার পর তিনি কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। এখানে তিনি শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নিতে শুরু করে দেন। তার পর ১৮৪৯ সালে হুগলী মহসিন কলজে ভর্তি হন এবং সেখানে ৮ বছরে জন্য পড়াশোনা জারি রাখেন। এর পর ১৮৫৬ সালে তিনি আইন পড়ার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৮৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দেন এবং কলেজের প্রথম দুজন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন।
বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 1838 খ্রিস্টাব্দের 26 শে জুন বাংলা 1245 , 13 ই আষাঢ় নৈহাটির কাঠাল পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি, লেখক এবং সাংবাদিক ছিলেন। ভারতের জাতীয় সংগীত বন্দে মাতরম তার লেখা বহু বছর আগে। বাংলা ভাষায় রচিত এই গানটি এখনও মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমকে সতেজ করে তোলে। আমাদের দেশের মহান লেখকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেরা স্থান অর্জন করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর মায়ের নাম দূর্গাদেবী । বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান । বঙ্কিমচন্দ্ররা তিন ভাই ছিলেন শ্যামাচরণ , সঞ্জীবচন্দ্র ও পূর্ণচন্দ্র । পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায় ।
কুল পুরােহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্য পাঁচ বছর বয়সে বঙ্কিমের হাতেখড়ি দেন । ভর্তি হলেন গ্রামের পাঠশালায় । রামপ্রাণ সরকার ছিলেন ঐ পাঠশালার গুরুমশাই । কোন অক্ষরই বঙ্কিমকে দ্বিতীয়বার দেখাতে হত না । গুরুমশাই অত্যন্ত অবাক হয়ে বলেছিলেন , “ এত তাড়াতাড়ি করে যদি সব লিখে ফেল তবে তােমাকে আর কতদিন পড়াতে পারব "।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর সাত – আট বছর বয়সেই প্রকৃত শিক্ষা শুরু হয় । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর বাবা তখন মেদিনীপুরের ডেপুটি সন ছিলেন । ১৯৪৪ খ্রি : ছয় বৎসর বয়সে সেখানে দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের সঙ্গে তাকেও উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় । মিঃ এফ . টিড সাহেব ছিলেন প্রধান শিক্ষক । এখানে বঙ্কিমচন্দ্র অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন । তিনি প্রধান শিক্ষকের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন ।
বঙ্কিমচন্দ্র কোন বছর অকৃতকার্য হতেন না । কয়েকবার বছরে দু’বার প্রমােশনও পেয়েছিলেন ।
বাবার বদলির জন্যও ১৮৪৯ খ্রঃ বঙ্কিমচন্দ্রকে মেদিনীপুর ত্যাগ করে আবার কাঠালপাড়ায় চলে আসতে হল । এখানে পন্ডিত শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শেখেন । মহাভারতের কথা বিশ্লেষণ করে বােঝাতেন পন্ডিত হলধর তর্ক চূড়ামণি ।
সে সময়ই বঙ্কিমের মনে সাহিত্যের বীজ দানা বাঁধতে লাগল । তিনি 1849 খ্রীষ্টাব্দের 28 শে অক্টোবর চুঁচুড়ায় হাজি মহম্মদ মহসীন কলেজে ( হুগলী কলেজ ) বিদ্যালয় বিভাগে ভর্তি হন । সেখানে তিনি জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 11 বছর বয়সে নারায়নপুর গ্রামের মােহিনীদেবী নামক এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তার প্রথম বিয়ে করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত 1859 সালে তার প্রথম স্ত্রী মারা যান। এর পর 1860 সালে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়।
কলেজে পড়ার সময় সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্য ও পদ্য লেখা বের হত । 1853 খ্রীষ্টাব্দে তিনি সংবাদ প্রভাকর ’ -এ কবিতা প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করেন । তাঁর কবিতা ( কামিনীর প্রতি উক্তি ) সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত হল ও তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পান । এই পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কবিতার এই প্রতিযােগিতার নাম দিয়েছিলেন কলেজীয় কবিতা – যুদ্ধ । মনে মনে ঈশ্বরচন্দ্রকে গুরুর আসনে বসিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ।
1853 খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃত সাহিত্যে গভীরভাবে আত্মনিয়ােগ করেন । এ সময়েই রচনা করেন ললিতা ’ ও ‘ মানস ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস:-
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ:-
কলেজে পড়ার সময় বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজী লেখায় ও পড়ায় অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন । নবীনচন্দ্র দাসের কাছেই ইংরেজী শিক্ষায় হাতে খড়ি হয় ।
সংস্কৃত ও গণিত শাস্ত্রে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল । গণিতের শিক্ষক যখন তাকে জ্যামিতির প্রতিপাদ্য বােঝাতেন তখন মন দিয়ে তা শুনতেন।এরপর বঙ্কিমচন্দ্র সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন এবং ট্রান্সফার নিয়ে চলে এলেন প্রেসিডেন্সী কলেজে । বঙ্কিমচন্দ্র প্রেসিডেন্সী কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ।
1848 খ্রীষ্টাব্দে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবর্তিত হল বি . এ . পরীক্ষা । এই পরীক্ষা খুবই কঠিন ছিল ।ভালভাবে পড়াশুনা করে তবেই ঐ পরীক্ষা দিতে হত । এজন্য ঐ বছরই এই পরীক্ষা দেবার কথা প্রথমে চিন্তা করেন নি । হঠাৎ পরীক্ষার দুই – তিন মাস আগে মন স্থির করলেন যে , ঐ বছরেই তিনি বি . এ . পরীক্ষা দেবেন । ঐ কলেজের অধ্যাপকরা ও ছাত্ররা তাকে ঐ পরীক্ষা দিতে নিষেধও করেছিলেন । কারণ তিনি এই সাধারণ বিভাগে বিশেষ কিছুই পড়াশনা করেন নি , কোন ক্লাশও করেন নি । এভাবে কোন ক্লাশ না করেও কিছুই পড়াশুনা না করে কোন ছাত্র পরীক্ষা দিতে পারে , এটা সকলের কাছে কল্পনাতীত ছিল ।বঙ্কিমচন্দ্র এ বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঐ পরীক্ষা দেন । সে বছর মােট তেরজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে দশজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন ।
বি . এ . পরীক্ষার ফল যখন বের হল তখন চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল । বঙ্কিমচন্দ্র এই পরীক্ষার সর্বপ্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু প্রথম বাঙালি হিসেবে গ্রাজুয়েট হলেন বঙ্কিমচন্দ্রের এই অসাধারণ কৃতিত্বে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ , পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , ছােট লাটসাহেব , অনেক ইংরেজ সাহেব ও দেশের মনীষীগন আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের এই কৃতিত্বের জন্য বঙ্গ সরকারের সচিব ইয়ং সাহেব বঙ্কিমচন্দ্রকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরী গ্রহণ করতে অনুরােধ করেন । পিতার সম্মতি নিয়ে 1858 খ্রিস্টাব্দে তিনি এই চাকরী নিয়ে চলে যান কর্মস্থল যশােরে । এই সময়েই তার সঙ্গে দীনবন্ধু মিত্রের পরিচয় হয় । এই সময়ই Rajmohan’s wife নামে একটি ইংরেজী উপন্যাস রচনার কাজেও হাত দেন তিনি ।
ইতিমধ্যে যশােরে 1859 খ্রীষ্টাব্দে স্ত্রী মােহিনী দেবীর মৃত্যু হয় । তখন বঙ্কিমচন্দ্রের বয়স মাত্র বাইশ বছর । প্রথমা পত্নীর বিয়ােগ । ব্যথা তাকেনিথর করে তুলেছিল । এবছরেই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গপ্তেরও মৃত্যু হয় ।
1860 খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র রাজলক্ষ্মী দেবীকে বিয়ে করেন । বঙ্কিমচন্দ্র খুলনা মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে 1860 খ্রীষ্টাব্দে 9 ই নভেম্বর যােগদান করেন । এসময় তিনি যশােহরের ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও পালন করেন । 1868 খ্রীষ্টাব্দের 5 ই মার্চ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কর্মজীবন:-
পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি যশোর শহরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের পদে চাকরি পান। যশোরে কয়েক বছর কাজ করার পর 1860 সালে তিনি মেদিনীপুরের নেগুয়ায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে যোগদান করেন। তার পর খুলনাতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে যোগদান করেন। এই ভাবেই তিনি বেশকিছু এলাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে কাজ করেন। যেমন –
এর মাঝে তিনি 1871 সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের পদ থেকে প্রমোশন পেয়ে তিনি মুর্শিদাবাদের কালেক্টর হয়ে ওঠেন।
সব শেষে 14 ই সেপ্টেম্বর 1891 সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চাকরি জীবন থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র মােট চোদ্দটি উপন্যাস রচনা করেন । উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য দুর্গেশনন্দিনী , কপালকুন্ডলা , মৃণালিনী , বিষবৃক্ষ , ইন্দিরা , যুগলাঙ্গুরীয় , চন্দ্রশেখর , রাধারাণী , রজনী , কৃষ্ণকান্তের উইল , রাজসিংহ , আনন্দমঠ , দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম । এছাড়া তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল কৃষ্ণচরিত , লােকরহস্য , বিজ্ঞানরহস্য , ললিতা , দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী , ধর্মতত্ত্ব , শ্রীমদ্ভাগবতগীতা প্রভৃতি ।
৮ ই এপ্রিল, ১৮৯৪ (২৬ শে চৈত্র ১৩০০ বঙ্গাব্দ) সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তবে তার রচনাশৈলীর মাধ্যমে তিনি আজও আমাদের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন।
আশা করছি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবনী টি আপনাদের ভালো লেগেছে।অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের "বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী"।
এই ভাবেই পাশে থাকুন যেকোনো প্ৰশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলাে করুন এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন , ধন্যবাদ।