সংজ্ঞা:
ছন্দ হলো কাব্য বা কবিতার অন্তর্গত একটি সংগঠিত ধ্বনিসাম্য, যা কবিতার লয়, তাল, মাত্রা এবং ধ্বনির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সৃষ্ট হয়। এটি কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং পাঠক বা শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ছন্দের মাধ্যমে কবিতার ভাব, আবেগ ও সৌন্দর্য আরও গভীরভাবে প্রকাশ পায়।
বিশ্লেষণ:
ছন্দের প্রধান উপাদানগুলি হলো:
লয় (Rhythm): লয় হলো কবিতার ধ্বনিগত গতি। এটি কবিতার পংক্তিগুলির ধ্বনির ওঠা-নামার পরিমিতি। লয়ের মাধ্যমে কবিতায় একটি ছন্দময় গতি সৃষ্টি হয় যা পাঠক বা শ্রোতার মনের উপর একটি নির্দিষ্ট প্রভাব ফেলে।
তাল (Meter): তাল হলো কবিতার পংক্তির মাত্রিক গঠন। এটি মূলত পংক্তির ভেতরে শব্দের মাত্রার বিন্যাস। বাংলা কবিতায় সাধারণত চতুর্মাত্রিক, অষ্টমাত্রিক এবং ষোড়শমাত্রিক তাল দেখা যায়।
মাত্রা (Foot): একটি পংক্তির অংশবিশেষ যা একটি নির্দিষ্ট ধ্বনিসংগঠনের মাধ্যমে গঠিত হয়। প্রতিটি মাত্রা একটি বা একাধিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে।
অন্ত্যমিল (Rhyme): অন্ত্যমিল হলো কবিতার পংক্তির শেষ শব্দগুলির ধ্বনিগত সামঞ্জস্য। এটি কবিতার ছন্দময়তায় একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ছন্দের প্রকারভেদ:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ: এখানে পংক্তির প্রতিটি অংশে নির্দিষ্ট সংখ্যক অক্ষর থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতায় এই ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ: এখানে পংক্তির প্রতিটি অংশে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রা থাকে। এই ছন্দে একটি পংক্তির দৈর্ঘ্য নির্ধারণ হয় মাত্রার উপর ভিত্তি করে।
স্বরবৃত্ত ছন্দ: এই ছন্দে স্বরধ্বনির পুনরাবৃত্তি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের "মেঘনাদ বধ কাব্য"।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে" কবিতায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়।
উদাহরণ:
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে
ভারতভাগ্যবিধাতা!
এই পংক্তিতে অক্ষরের নির্দিষ্ট বিন্যাস ছন্দ তৈরি করেছে যা কবিতার পাঠকে ছন্দময় করে তোলে।
ছন্দের গুরুত্ব:
ছন্দ কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং পাঠকের মনে একটি গভীর প্রভাব ফেলে। এটি কবিতার ভাব এবং আবেগের প্রকাশে সহায়ক। ছন্দ ছাড়া কবিতা অনেকটা সুরবিহীন সঙ্গীতের মতো শোনায়, যা তার পূর্ণতা হারায়।
সারসংক্ষেপে, ছন্দ হলো কবিতার মর্মস্থল যা তার আবেগ, সৌন্দর্য এবং ভাব প্রকাশের মাধ্যম। এটি কবিতাকে শুধু সুন্দর করে তোলে না, বরং পাঠকের মনোজগতে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
-ধন্যবাদ